বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে ২৬ আগস্ট সাত সাংবাদিককে পেটানো হয়েছে। আর কেবল বরিশাল বলে কথা নয়, সারা দেশেই সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে। বরিশালের প্রবচন অনুসারে ‘আলে গোনে কলে গেলে’ অথবা প্রচলিত প্রবচন, পান থেকে চুন খষলেই ‘পিটা সাংবাদিক।’ এ ধারায় নেতা-পাতা-ছাতা-আমলা-কামলা-ডাক্তার-মোক্তার-চাকর-বাকর, সবাই শামিল। একাট্টা, এক জোট। একেবারে হরিহর আত্মা। আর সাংবাদিক পেটানো, হত্যা করা, গুলি করে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়া- এসব চলে আসছে লাগাতারভাবে, বহু আগে থেকে। যত দিন যায় ততই বাড়ছে এর তীব্রতা।
সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা এবং বাড়ছে সাংবাদিক সমাজ ও সাংবাদিক নেতাদের নীরবতা। তাঁরা যেন মূক ও বধির। অথবা নির্বাক চলচ্চিত্রের একেকটি চরিত্র। অথবা পেশাগত প্রাচীনকালের খোজা। এদিকে কারও কারও ধারণা, সাংবাদিকরা বোবা প্রাণী হয়ে গেছে। মাঠে কেউ গরু পেটালে মুরব্বিরা বলেন, ‘এই তুমি বোবা প্রাণীটা মারো কেন!’ কিন্তু সাংবাদিকদের বিষয়ে এমনটা বলারও যেন কেউ নেই। কেউ কিছু বলে না। তবে সাংবাদিক নেতাদের ব্যাপারে অনেক কথাই বলা হয়। যা সবার ব্যাপারে সত্য না হলেও কারও কারও ব্যাপারে নিশ্চয়ই সত্য। ওই যেমন কথা আছে না, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। তেমনই সাংবাদিক নেতাদের কেউ কেউ যত না সাংবাদিক তার চেয়ে অনেক বেশি অন্য কিছু। যে মানুষগুলো সাংবাদিক নেতার জার্সি পরে আছেন। এদের কারণে দূষিত হতে হতে গণমাধ্যম সংকটের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর এই দূষণের জন্য যারা দায়ী তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছেন, যাদের সাগরে চুবিয়ে মারলে খুন মামলার আগে হয়তো হবে সাগর দূষণের মামলা।
ওপরে-নিচে-ভিতরে দূষণের ফলে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যাতে গণমাধ্যম এখন প্রায় ফোকলা। এর নানান ধরনের কুফলের মধ্যে একটি হচ্ছে সাংবাদিক পেটানোর বিষয়টি খুবই মামুলি ব্যাপার হয়ে যাওয়া এবং এর কোনো কার্যকর প্রতিবাদ নেই। চলমান দৈন্যদশার সূচনা হয়েছে এই সেক্টরে ইঁদুর চরিত্রের কতিপয় মালিকের অনুপ্রবেশ এবং কতিপয় অসাংবাদিকের সাংবাদিক নেতা হয়ে ওঠার ফলশ্রুতিতে। এদিকে পেশাদার সাংবাদিকরা অনেকটা লাজুক পান্ডার মতো গুটিয়ে থাকার অবস্থায় আছে। তারা একেকজন বিচ্ছিন্ন দীপ। যে বিষয়টি আর একবার প্রমাণিত হলো ২৬ আগস্ট বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুই সহযোগী অধ্যাপকের সক্রিয় অংশগ্রহণে সাত সাংবাদিকের ওপর হামলার ঘটনায়। তবে রহস্যজনকভাবে সমস্যার ‘মিটমাট’ হয়ে গেছে ঘটনাস্থলেই। এ হামলার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ মৌখিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে। আর এটি মেনে নিয়েছে বরিশালের সাংবাদিক সমাজ। এর আগে ঘটনাস্থলে বরিশালে সাংবাদিক নেতা হিসেবে পরিচিত দুজন টেলিভিশনে ব্যক্ত করেছেন সাবধানী প্রতিক্রিয়া। আর সাংবাদিকদের ওপর হামলার পাঁচ দিনের মাথায় ৩০ আগস্ট নগরীর মহাত্মা অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে সুশীল মানববন্ধন করেছে বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন। যা কারও কারও বিবেচনায় দাফনের পর জানাজা পড়ার মতো বিষয়। এরপরও স্বপন খন্দকারকে অনেকেই ধন্যবাদ দিতে চান। কারণ কাকস্নানের মতো হলেও তিনি একটা প্রতিবাদের আয়োজন করেছেন। এ মানববন্ধনে অন্যান্য সাংবাদিক সংগঠনের পরিচিত মুখগুলো দেখা গেছে। তাও যেন দূরসম্পর্কের কারও জানাজায় অংশগ্রহণ করার মতো।
উল্লেখিত মানববন্ধন থেকে বিচার চেয়ে ১০ দিনের আলটিমেটামের আওয়াজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই আলটিমেটামের ফলাফল কারও বুঝতে আর বাকি থাকার কথা নয়। আর এও বোঝা গেছে, সাংবাদিক পেটালে কার্যকর প্রতিবাদ করার মতো এখন আর কেউ নেই। এ কারণেই হয়তো অকাল মৃত্যুর অর্ধযুগ পেরিয়েও কথায় কথায় বরিশালের সাংবাদিকরা এখনো লিটন বাশারকে স্মরণ করেন। কিন্তু এই স্মরণের চেতনা ধারণ করার মতো সাংবাদিক নেতা হয়তো বরিশালে কমে গেছে। অথবা আকাল চলছে। এদিকে কেউ কেউ বলেন, ছোটখাটো ক্ষমতা কেন্দ্রের অবিচারের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা এখন আর বরিশালের সাংবাদিক নেতাদের নেই। অথচ বছর দশেক আগেও বরিশালের দৃশ্যপট ভিন্ন ছিল।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ প্রকাশিত, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩