Home বিশেষ প্রতিবেদন অস্ত্র নিয়ে শুরুতে রহস্যজরক আচরণ করেছে ভারত

অস্ত্র নিয়ে শুরুতে রহস্যজরক আচরণ করেছে ভারত

শুরুর দিকে পাকবাহিনী বরিশাল আক্রমন করেনি। ঢাকায় ২৫ মার্চ গণহত্যা চালাবার পর বরিশালের মাটিতে পা রাখতে সময় নিয়েছে পুরো একমাস। কিন্তু কেন? হতে পারে, সাহস দেখায়নি। অথবা অন্য কোন দুরভিসন্ধি ছিলো। অস্ত্র না দেবার ক্ষেত্রে ভারত শুরুতে অনেক রহস্যজরক আচরণ করেছে। এনায়েত চৌধুরী জানান, সামরিক ব্যক্তি ছাড়া ভারত অস্ত্র হস্তান্তর করতে অনীহা প্রকাশ করতো।
এদিকে ঢাকাকে পদানত করার ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে বরিশালের মতো তুলনামুলক অধিকতর একটি বৈরী এলাকায় প্রবেশে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিতে চেয়েছিলো ছিলো হানাদার বাহিনী। যে কারণে শুরুর দিকে আক্রমন না করে একমাস সময় নিয়েছে। একই সময়ে খতিয়ে দেখেছে নানান দিক। পাকবাহিনীর গোয়েন্দা তথ্য ছিলো, বরিশালের ঘরেঘরে রয়েছে ভারতীয় অস্ত্র! যদিও বাস্তবতা মোটেই এমনটি ছিলো না। এদিকে শুরুর দিকেই পাকিস্তানী বাহিনী আক্রমন করেনি বলে নিশ্চিন্তে বসেছিলো না বরিশাল। বরং বরিশাল শহর ছিলো উত্তপ্ত, সঙ্গে চলছিলো যুদ্ধের প্রস্তুতি। সে এক অন্যরকম বরিশাল!
এ প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা মনসুরুল আলম মন্টু তাঁর ‘বরিশাল মুক্তিযুদ্ধের সদরে অন্দরে’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘হেমায়েতউদ্দিন প্লে গ্রাউন্ডেন একটি জনসভা হলো সম্ভবত ৭ মার্চ। সেটা ছিলো সম্পূর্ণই আওয়ামী লীগের সভা। প্লে গ্রাউন্ড মানুষে ভরে গিয়েছিলো। একটু খালি ছিলা না। সাধারণ মানুষের আশা এরা হয়তো কিছু ঘোষণা করে দেবে, বলবে সামনে কি হবে। উত্তেজনার অন্ত নেই।’ মনসুরুল আলম মন্টু তাঁর গ্রন্থে আরো লিখেছেন, ‘ সম্ভবত শামসুল আলম বললে, আজ হোক কাল হোক আমাদেরকে যখন যুদ্ধ করতেই হবে তখন এখন থেকেই ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা উচিত।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা মনসুরুল আলম মন্টু তার বইতে যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা থেকে একেবার স্পষ্ট, পাকিস্তানীদেরকে সশস্ত্র প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বরিশাল অপেক্ষায় কালক্ষেপন করার ধারায় ছিলো না। বরং অনিবার্য জেনেই যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েছিলো। তবে তখনও অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে অনিশ্চয়তা ছিলো। তবে এটি মুক্তিকামী মানুষের মনোবলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি।
মুক্তিকামী মানুষের এই মনোবল আরো বেড়ে যায় মেজর জলিলের দৃপ্ত উচ্চারণ, ‘বরিশাল শহরকে দুর্গের মত গড়ে তোলা হবে। যে কোন মূল্যেই হোক পাক সেনাদের আক্রমন প্রতিহত করা হবে। প্রয়েজনীয় অস্ত্রও সংগহ করা যাবে।’ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ২৫ মার্চে থেকে একমাস সময় পাওয়া সত্ত্বেও বরিশালকে মোটেই ‘দুর্গের’ মতো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এদিকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগহের কথা বলা হলেও পাক সেনা ‘প্রতিহত’ করার জন্য ভরসা ছিলো রাইফেল ও কয়েকটি হালকা মেশিনগান।

মুক্তিযাদ্ধা এনায়েত চৌধুরী জানান, ২৬ এপ্রিল বরিশাল আক্রান্ত হবার অন্তত দুই দিন আগে ২৪ এপ্রিল মেজর জলিল অস্ত্র আনার জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে বরিশাল ত্যাগ করেছিলেন। তার সঙ্গে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা। উল্লেখ্য, অস্ত্র না দেবার ক্ষেত্রে ভারত শুরুতে অনেক রহস্যজরক আচরণ করেছে। এনায়েত চৌধুরী জানান, সামরিক ব্যক্তি ছাড়া ভারত অস্ত্র হস্তান্তর করতে অনীহা প্রকাশ করতো। এদিকে ভারতের অস্ত্রের জন্য বসে থাকেনি বরিশালবাসী। বরং জনতা নিমজ্জিত ছিলো অনন্য উচ্চতার এক উদ্দীপনায়! বঙ্গবন্ধুর জাগিয়ে দেয়া চেতনার উপর ভর করেই বরিশালবাসী মুখোমুখি হয়েছে হানাদার বাহিনীর।

উল্লেখ্য, অস্ত্রের জন্য ২৪ এপ্রিল মেজর জলিলের ভারত যাত্রায় যে ফলই আসুক, অস্ত্র আসেনি। এ ছিলো বিফল যাত্রা। তবে এটিই একমাত্র ভারতীয় অস্ত্র প্রাপ্তির আশায় বিফল যাত্রা নয়। দিন পনেরো আগেও ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহের প্রয়াস বিফলে গেছে। দ্রুত গতিসম্পন্ন সাহারুন্নেছা লঞ্চ নিয়ে কাপ্টেন নূরুল হুদার নেতৃত্বে একটি দল অস্ত্র সংগ্রহের জন্য বঙ্গোপ সাগর পর্যন্ত গিয়েছিলো। এ খবরে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে বেশ পুলক জেগেছিলো। আশাকারা হয়েছিলো, এবার গ্রেনেড-মাইন আসবে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই আসেনি। কোথাও কোন অস্ত্র পাওয়া যায়নি। যেনো সেই নাটক, ‘কোথাও কেউ নেই।’

অথচ কথা ছিলো, বঙ্গোপ সাগরে ভারতীয় জাহাজ অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করবে। কিন্তু কোথাও কোন জাহাজের নামগন্ধ ছিলা না। অস্ত্র সংগ্রহের এ বিফল হবার খবরে কাম্পে ট্রেনিংরত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে হতাশা দেখা দিলো। এ প্রসঙ্গে সেসময় লাকুটিয়া ক্যাম্পে গেরিলা ট্রেনিংরত মনসুরুল আলম মন্টু তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমরা দমে গেলাম।’

এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা পেয়েযায় দেশবাসী। এ ক্ষেত্রে বরিশাল ছিলো অগ্রগামী। সব সময়ই বরিশাল অগ্রসর জনপদ হিসেবে বিবেচিত। অসহযোগ আন্দোলন, ধর্মঘট ও বিক্ষোভে উত্তাল ছিলো বরিশাল। মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলোতেও এর ব্যাত্যয় ঘটেনি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ছাত্র-জনতা ও প্রশাসন একই লক্ষে এগুতে থাকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের আলোকে। চলতে থাকে শত্রু মোকাবিলার জোর প্রস্তুতি, চেতনায় ও প্রশিক্ষণে।
এদিকে আলোচনা ও প্রস্তুতি- এ ধারায় ১ মার্চ পূর্বানী হোটেল এক বৈঠকে গণপরিষদের সদস্যদের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা ছিলো, পাক বাহিনী আক্রমন করলে জেলার প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করবেন নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা। সঙ্গে থাকবেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। থাকবেন অন্যান্য দলের স্বাধীনতাকামীরাও। রাখতে হবে ছাত্র নেতাদেরকেও। ডিসি-এসপিরা বাঙ্গালী হলে তাদেরকে প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার নির্দেশনা ছিলো। জেলা পর্যায়ে একটি স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট নির্দেশনা ছিলো বঙ্গবন্ধুর। এই নির্দেশনা পুরোপুরি পালিত হয়েছে বরিশালে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

পাকিস্তানে বন্ধ টুইটার, কারণ জানাল সরকার

দখিনের সময় ডেস্ক: জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে চলিত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে পাকিস্তানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার (বর্তমানে এক্স) বন্ধ রয়েছে। মূলত দেশেটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল...

আবার চালু হচ্ছে আইএসপি লাইসেন্স আবেদন

দখিনের সময় ডেস্ক: দেড় মাস বন্ধ থাকার পর ফের চালু হচ্ছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা (আইএসপি) সরবরাহের লাইসেন্স প্রাপ্তির আবেদন কার্যক্রম। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি)...

ফোন পানিতে পড়ে গেলে করণীয়

দখিনের সময় ডেস্ক: দৈনন্দিন জীবনে অনেকেই স্মার্টফোনের ওপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন কাজে আমরা ফোনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। তবে একটু অসতর্ক থাকলে যেকোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।...

গরমে চুলের যত্ন নেবেন কীভাবে?

দখিনের সময় ডেস্ক: গরমে দিনের বেলায় কয়েকবার পর্যন্ত গোসল করতে হচ্ছে। শরীরকে ঠান্ডা রাখার জন্য মাঝেমধ্যে ঘাড়ে-মাথায় পানি দিচ্ছেন অনেকে। এতে শরীরে স্বস্তি মিলছে। কিন্তু...

Recent Comments