বরিশাল রক্ষায় বাংকারে বসে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে পাক বাহিনীর গান বোট ‘প্রতিরোধে’ যারা গুলী ছুড়ছিলেন তাদের অনেকেই গোলার আঘাতে শহীদ ও আহত হলেন। প্রচন্ড গোলার মুখে বাংকারে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছিলো। অনেকে পালালেন। কেউ রাইফেল নিয়ে, কেউ রাইফেল ফেলে। দুএকজন আরো কিছু ফেলে, কেবল জীবন নিয়ে পালিয়েছিলেন অনেকে।
ঘন্টা তিনেকের মধ্যে ঝুনাহারে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। একটি প্রতিরোধ গুলি বর্ষণের মতোও কেউ ছিলো না। কিন্তু এরপরও অজ্ঞাত কারণে পাক বাহিনী সামনের দিকে আগায়নি। হয়তো সামনে আরো বড় কোন প্রতিরোধের আশংকা করছিলো। অথবা অন্য কোন কৌশলের ব্যাপার ছিলো।
মনসুরুল আলম মন্টু তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বেলা ২টার দিকে মঞ্জু ভাই তালতলী এলাকা ছেড়েছেন। তিনি বরিশাল শহরের দিকে গেলেন। আমু ভাই আমাদের বললেন, জ¦ীপে ওঠো, আর থাকাটা ঠিক নয়।………..শেষ মূহুর্তে পালাচ্ছি। এটা আগে করলে এতোটা তাড়াহুড়া করতে হতো না।…….কালিজিরা পৌঁছে গেলাম অল্প সময়ের মধ্যে।’
কালিজিরায় ফেরী ছিলো না। তবে বরিশালের এসপির লঞ্চটি নোঙ্গর করা ছিলো। এই লঞ্চে উঠে পড়েন আমির হোসেন আমু এবং তার সঙ্গে থাকা লোকজন। কিন্তু বেঁকে বসলো লঞ্চের সারেং ও অন্যান্য স্টাফরা। তারা এসপির অনুমতি ছাড়া লঞ্চ ছাড়তে রাজি হচ্ছিলো না। পরে অনাহুত যাত্রীদের হাতে অস্ত্র এবং কথাবার্তা শুনে নোঙ্গল তুললো। লঞ্চ ছাড়ার মুহূর্তে সেখানে ছুটতে ছুটতে এলো কাটপট্রির খগেন সাহার ছোট ভাই কুট্রি সাহা।
মনসুরুল আলম মন্টু তার বইতে লিখেছেন, ‘হাফাতে হাফতে বললো, আপনারা এখানে, আর ওদিকে সদর রোডের সাহেবের গোরস্থানের কাছে ন্যাশনাল ব্যাংক (বর্তমানে সোনালী) থেকে সমস্ত টাকা পয়সা……..। ওকে আর বলতে দিলো না আমু ভাই। বলল, টাকা পয়সা সবাই নিয়ে নিচ্ছে? কুট্রি সাহা ঢোক গিলে বললো, হ্যাঁ আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমাদের কি হলো কে জানে। আমরা বললাম, ইন্ডিয়া যাবো, আমাদেরও তো টাকা পয়সা দরকার চলো আমরা ব্যাংকে যাই। আমরা সবাই টাকা নেবার জন্য লুঙ্গি বের করে তার এক প্রাপ্তে গিট দিয়ে থলের মত তৈরী করে জ¦ীপে লাফ দিয়ে উঠলাম আবার।…….ঊর্ধশ্বাসে আমরা আবার শহরে চলে এলাম। তখনো পাক মিলিটারী বরিশাল শহরে প্রবেশ করেনি। তবে ঝুনাহারের পতন ঘটেছে বেশ কতক্ষণ আগে।’
মনসুরুল আলম মন্টুর ভাষ্যমতে তারা ন্যাশনাল ব্যাংকের সামনে এসে দেখলেন, ব্যাংক ভবনটি জনশুন্য। তবে একটু আগে যে ওখালে ঝড় বয়েগেছে সেটা বোঝা যাচ্ছিলো। দু’একজনের কাছে খবর পাওয়াগেলো, কয়েকজন এসেছিলো এবং তারা টাকা নিয়ে গেছে। খবর নিয়ে জানাগেলো, সম্ভবত লাকুটিয়ার দিকে গেছে। তারা ছুটলের লাকুটিয়ার দিকে। কিন্তু ঝুকিপূর্ণ এই যাত্রায়ও কিছু মেলেনি।
বিফল প্রয়াসে ইতি টেনে তারা আবার ভারতে যাবার জন্য কালিজিরা মুখি হলেন। তখন তারা ভাড়াক্রান্ত ছিলেন অর্থের সংস্থান করতে না পাবার কারণে। যেমন প্রথম দফায় তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন আবগারির তিন মন গাঁজা বিক্রি করে অর্থের সংস্থান করার ক্ষেত্রে। প্রথম দফায় বিফল চেষ্টার মতোই ব্যাংকের টাকা পাবার চেষ্টাও মাঠেমারা গেলো।
তবে শেষতক অর্থের সংস্থান হয়েছিলো। অপ্রত্যাশিতভাবে। ট্যাংকারের তেল ব্রিক্রি করে। যখন টাকা পাবার কোনই আশাই ছিলো না। এ ঘটনার মধ্যদিয়ে একটি কঠিন বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। তা হচ্ছে, পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে কেবল সামরিক দিক থেকে নয়, আর্থিক দিক থেকেও করুন দশায় ছিলেন জেলা পর্যায়ের নেতৃত্ব এবং মুক্তিযোদ্ধারা।