Home নির্বাচিত খবর মৃত্যুকুপ থেকে প্রাণে বেঁচে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন আলতাফ চৌধুরী

মৃত্যুকুপ থেকে প্রাণে বেঁচে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন আলতাফ চৌধুরী

আলম রায়হান ॥

বরিশাল সদর উপজেলার কড়াপুর ইউনিয়নের কড়াপুরের বনেদী ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান আলতাফ চৌধুরী। পেশাগত জীবনে ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। তার ছিলো প্রাচুর্য ও সম্মানের জীবন। ছিলেন নিরাপদে। কিন্তু তিনি এই আয়েশী জীবনে আচ্ছন্ন থাকেনি। বরং বঙ্গবন্ধুর ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আলতাফ চৌধুরীর বাড়ির ৫ জন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ফলে এ বাড়ি যুবক শূন্য হয়ে পড়ে।

পাক হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চের কালরাতে হামলার প্রথম টার্গেটের মধ্যে অন্যতম ছিলো রাজারবাগ পুলিশ লাইন। এখানে আরো ৫ জনের সঙ্গে একরকম মৃত্যুকুপে আটকা পড়েছিলেন আলতাফ চৌধুরী। সেখান থেকে ভাগ্যক্রমে মুক্ত হয়ে নবাবপুরে বড় ভাইর বাসায় আশ্রয় নেন। সেখান থেকে প্রধানত তিনদিন পায়ে হেটে কড়াপুরে গ্রামের বাড়িতে পৌছান। এরপর বরিশালের কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মাস্টারের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তারা প্রথমেই বরিশাল কোতয়ালী থানা নিয়ন্ত্রনে নিয়েনেন। এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের অভিজ্ঞতার আলোকে থানার সমুদয় অস্ত্রের দায়িত্বে ছিলেন আলতাফ চৌধুরী। উল্লেখ্য, তখন বরিশালে কোতয়ালীই ছিলো একমাত্র থানা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ হোসেন চৌধুরী ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পুলিশ অফিসার হিসাবে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অবস্থান করছিলেন। তবে সতর্ক ছিলেন। ২৫ শে মার্চ কালরাতে যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাক হানাদার বাহিনী চারদিক থেকে আক্রমণ চালালে পুলিশ বাহিনী প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। সেনাবাহিনীর ভাড়ী অস্ত্রের সঙ্গে সাধারণ অস্ত্র নিয়ে বেশিক্ষন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছিলো অকল্পনীয় এক অসম যুদ্ধ। এ সময় অনেক পুলিশ সদস্য রাজার বাগ পুলিশ লাইনে হানাদার বাহিনীর আক্রমণে জীবনকে উৎসর্গ করেন। এদিকে এক পর্যায়ে আলতাফ চৌধুরীসহ ৬ জন পুলিশ কর্মকর্তা একটি রুমে আটকা পড়েন। প্রতিরোধ যুদ্ধ চলাকালে তার রুমের ৪ জন মৃত্যুবরণ করেন। আলতাফ চৌধুরীসহ দুজন কোন রকম রুম থেকে বের হতে সক্ষম হন। ফজরের আজানের পর তিনি হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরে নবাবপুরে তার ভাই  মোতাহার চৌধুরীর বাসায় যান। তার এই পুলিশ অফিসার ভাই আদালতে কর্মরত ছিলেন। আলতাফ চৌধুরী তার ভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নেন।

এদিকে সারা ঢাকায় পাক বাহিনীর গণগত্যা অব্যাহত ছিলো। এক ফাঁকে তারা দুই ভাই সিভিল ড্রেসে বরিশাল রওয়ানা করেন। তার বড় ভাই রওয়ানা হন সাইকেলে করে। আলতাফ চৌধুরী রওয়ানা হন পায়ে হেটে। পায়ে হেঁটে ও বিভিন্ন মাধ্যমে আলতাফ চৌধুরী তিনদিন পর কড়াপুরে গ্রামের বাড়িতে পৌছান। ইতিমধ্যে জানতে পারেন, তার সহকর্মী অনেকেই পাকবাহিনীর গুলিতে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং কেউ কেউ গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

এ অবস্থায় আলতাফ চৌধুরী জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তার প্রথম সন্তান নবজাতক। এই কচি মুখও তাকে কঠিন যুদ্ধে যাবার সংকল্প থেকে একবিন্দুও টলাতে পারেনি।

পুুলিশ কর্মকর্তা আলতাফ চৌধুরী সেনাবাহিনীতে চাকুরীরত আব্দুল মজিদ তালুকদারের সাথে দেখা করেন। তখন বাবুগঞ্জের বেইস কমান্ডার সুলতান মাস্টার আত্মীয় হিসেবে এক সময় আলতাফ চৌধুরীদের বাড়িতে গৃহশিক্ষক ছিলেন। আব্দুল মজিদ তালুকদার ও সুলতান মাস্টারসহ তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পরিকল্পনা করেন।

যেহেতু মজিদ তালুকদার সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন এবং আলতাফ চৌধুরী পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন সেহেতু সুলতান মাস্টার যুদ্ধের জন্য আরো বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক হিসাবে সুলতান মাস্টারকে বেইস কমান্ডার হিসেবে গ্রহণ করে তারা বরিশাল সদর গার্লস স্কুলে জালাল সরদারের সাথে যোগাযোগ করেন।

প্রকৃতিগতভাবে সুলতান মাস্টার একজন শিক্ষক হিসেবে কড়াপুর বসুরহাটে চৌধুরী বাড়ি বেশি সময় অবস্থান করতেন। এবং সেখান থেকে ওই বাড়িসহ এলাকার অনেক যুবককে মুক্তিযুদ্ধে আংশ নিতে অনুপ্রানিত করেন। সুলতান মাস্টার বারুখা দিঘির পাড়ে  মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দিতেন। বসুরহাট ছিল তখন ঐ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাজার এবং ওখানে  ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ছিল। এই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকাশ্য পদচারণা ছিলো। এ কারণে এই অঞ্চলের অধিক সংখ্যক যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অধিক অনুপ্রানিত হয়। এখানকার মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আজও প্রমান করে যে, সুলতান মাস্টারের নেতৃত্বে বরিশালে স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। সুলতান মাস্টারের প্রধান সহযোগী ছিলেন আক্তার আলী খন্দকার ও মোঃ হোসেন আলী হাওলাদার।

দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন তারা বরিশাল কোতয়ালী থানায় অবস্থান নেন এবং সেখান থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে দেশীয় অস্ত্র সংগ্রহ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করেছেন। ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত হয়। এরপরের দিন মজিদ তালুকদার ও আলতাফ চৌধুরী দুইজন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। এবং  দুইজন নিজনিজ ডিপার্টমেন্টে যোগদান করেন।

আলতাফ হোসেন চৌধুরী একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আবার তার চাকরি জীবনে স্বাধীন বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট কালরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর আলতাফ চৌধুরী স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পুলিশ বাহিনীর চাকরি থেকে নিজে পদত্যাগ করেন।

এদিকে সেনাবাহিনীর অন্য রকম পরিস্থিতির কারণে আলতাফ চৌধুরীর বড় ভাই মোতাহার চৌধুরী বহু চেষ্টা করেও চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে পারেননি। চাকরি অবস্থায় তিনি নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের  সৈনিক হিসেবে সর্বত্র পরিচয় দিতেন। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আসার পর আগারগাঁও পাকা মার্কেটে শেরেবাংলা নগর এলাকায় মোহাম্মদ হানিফ ও আবদুস সাত্তারসহ শেখ হাসিনার পক্ষে তৎপরতা চালান মোতাহার চৌধুরী। এজন্য তাঁকে চাকুরী থেকে সাসপেন্ড করা হয়।

এরপরে আলতাফ চৌধুরী রিক্সার ব্যবসা শুরু করেন। কিছুদিন পর সরকার তাঁকে আবার চাকুরীতে ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু তার উপরে সবসময়ই নজর রাখা হতো। তবে কোন অবস্থাতেই তাকে আওয়ামী লীগ থেকে ফেরাতে না পারায় তাকে আবার বিভাগীয় শাস্তি প্রদান করা হয়। এ অবস্থায় মুজিব কর্মী হিসেবে ১৯৮৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন আলতাফ চৌধুরী। তার পরিবারের সদস্যরা এবং সন্তানরা আজও বঙ্গবন্ধুর মুজিব আদর্শের সৈনিক হিসাবে মুক্তিযোদ্ধা পিতার আদর্শ ধারণ করে আছেন। তারা সকলেই নিজ-নিজ পেশার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

স্মার্টফোনে ইন্টারনেট চলে যাচ্ছে? জেনে নিন গতি বাড়ানোর কৌশল!

দখিনের সময় ডেস্ক: অনেকেই মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করার সময় হঠাৎ করেই দেখেন, নেটওয়ার্ক চলে গেছে। আশেপাশের অন্যরা নির্বিঘ্নে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারলেও আপনার ফোনেই সমস্যা...

প্রতিদিন ৩-৪ লিটার পানি পান করলে কী হয়?

দখিনের সময় ডেস্ক: ওজন কমানো একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ হতে পারে। কঠোর ডায়েট অনুসরণ করা, খাবারের প্রতি লোভ নিয়ন্ত্রণ করা, প্রতিদিন জিমে যাওয়া, কঠোর ওয়ার্কআউট করা...

ডিভোর্সের দুদিন পরই সুখবর দিলেন এ আর রহমান

দখিনের সময় ডেস্ক: নিন্দুকরা মনে করছে বাংলার মেয়ে গিটার বাদক মোহিনী দে-র জন্যই হয়ত সায়রাকে ছেড়েছেন ভারতের অস্কারজয়ী সংগীতশিল্পী ও সুরকার এ আর রহমানের। তবে...

যৌন পর্যটনের নতুন কেন্দ্র টোকিও, সেক্স ইন্ডাস্ট্রির জড়িত কিছু চক্র

দখিনের সময় ডেস্ক: যখন স্বর্ণযুগ ছিল, শহরটি অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি দেখেছে। এটি এখনো বিশ্বের অন্যতম বাসযোগ্য শহর হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে আশঙ্কার বিষয়...

Recent Comments