দখিনের সময় ডেস্ক:
এক সময় নকল বলতে প্রথমেই মুখে আসতো জিনজিরা কথা। ভাবখানা এই ছিলো, যা কিছু আসল সব জাপান আর যাকিছু নকল তা জিনজিরা। কিন্তু এটি একেবারেই অতীত। কলংক তিলক মুছে জিনজিরা এখন অহংকারের ঠিকানা। দেশের গর্ব এখন ‘মেড ইন জিনজিরা।’
বুড়িগঙ্গা নদীর তীরঘেঁষে রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প এলাকাটির নাম জিনজিরা তাওয়াপট্টি। এক সময় পণ্যের গুণগত মান সামান্য খারাপ বা একই রকম (নকল) হলেই ‘মেড ইন জিনজিরা’ বলে উপহাস করা হতো। তবে এখানে তৈরি যন্ত্রাংশ টেকসই ও মানসম্মত হয়ে ওঠায় সেই উপহাস এখন অহঙ্কারে পরিণত হয়েছে। এখানকার যন্ত্রাংশের বেশ চাহিদাও রয়েছে। রাজধানীর নয়াবাজার, ধোলাইখাল, চকবাজার, নবাবপুরসহ বিভিন্ন মার্কেটের দোকানদারদের মাধ্যমে সারাদেশে সরবরাহ করা হয় এসব যন্ত্রাংশ। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষের।
প্রায় ৭০ বছর আগে রুটি ভাজার কড়াই (তাওয়া) তৈরির কারখানা দিয়ে শুরু হয় ‘মেড ইন জিনজিরা’ শিল্পের যাত্রা। এরর গড়ে উঠতে শুরু করে ছোট বড় বিভিন্ন কারখানা। পরে এলাকাটির নাম হয়ে ওঠে তাওয়াপট্টি। এখানকার কারখানায় তৈরি হয় নানা যন্ত্রাংশ। কারিগরদের দক্ষতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কোনো যন্ত্রাংশের নমুনা দিলে, তা হুবহু তৈরি করতে পারেন তারা।
জিনজিরা এলাকা এখন ‘বাংলার চীন’, ‘বাংলার জাপান’ বা ‘মেড ইন জিনজিরা’ নানান বিশেষণে পরিচিত। করোনা মহামারীর ধকল কাটিয়ে নিজেদের প্রচেষ্টায় টিকে আছে ছোট ছোট টিনের ঘরের এসব কারখানা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনীয় সরকারি সুবিধা পেলে এখানকার তৈরি যন্ত্রাংশ বিদেশেও রপ্তানি সম্ভব।
তাওয়াপট্টির কারখানাগুলোতে নাট-বল্টু, ওয়াসা, স্প্রিং, দরজার কবজা, ছিটকিনি, বার্নার, ক্যালাম, টোপ ওয়াসার, প্ল্যানজার, কলের বাকেট, হ্যাশবল, তালা, শাটার স্প্রিং, স্ক্রু, রিপিটসহ সব ধরনের হার্ডওয়ার সামগ্রীসহ গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি মেশিনে উৎপাদিত হয় এসব যন্ত্রাংশ। কাঁচামালও আমদানি করতে হয় না তাদের। জাহাজ ভাঙার স্ক্র্যাপ, বিভিন্ন শিল্পকারখানা, রোলিং মিল, নির্মাণাধীন স্থাপনার বাতিল লোহা ও শিট সংগ্রহ করে সেগুলো থেকে নানা যন্ত্রপাতি তৈরি করেন তারা।
কারখানার ব্যবসায়ীরা জানান, এক সময় রিপিট তৈরির অটোমেশিন জাপান থেকে আমদানি করতে হতো। তখন একটি মেশিনে খরচ পড়ত ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা। কিন্তু তাওয়াপট্টির কারিগররা সেই মেশিন মাত্র আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকায় তৈরি করছেন। এ ছাড়া স্প্রিং তৈরির মেশিন ভারত থেকে আনতে খরচ হয় ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। তাওয়াপট্টিতে একই মেশিন তৈরি হয় ১ লাখ ২০ হাজার টাকায়।
মুজিবর নামের এক ব্যবসায়ী জানান, তাওয়াপট্টির কারিগরদের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। কাজ করতে করতেই তারা একসময় দক্ষ হয়ে ওঠেন। আমাদের কারিগররা যে কোনো যন্ত্রাংশ দেখলে হুবহু তৈরি করে দিতে পারেন। অনেকেই এটাকে নকল বললেও এটা নকল নয়, অনুকরণ। এখানকার যন্ত্রাংশ আমদানীকৃত যন্ত্রাংশের চেয়ে দামে কম, তবে মানের দিক দিয়ে কোনো অংশে কম নয়।
মামার লেদমেশিনে ১৬ বছর ধরে কাজ করা কারিগর হৃদয় বলেন, এখানে যন্ত্রাংশ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি মেশিন। যে মেশিন দিয়ে কাজ করি এটা আমার মামার বানানো। যে কোনো ধরনের মেশিন বা তার যন্ত্রের স্যাম্পল (নমুনা) দিলে এখন আমি নিজেই তৈরি করে দিতে পারি। মামার কাছ থেকে দেখে দেখে কাজ শিখে নিয়েছি।
তাওয়াপট্টির ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- করোনা মহামারীর বিরাট ধাক্কা নিজেদেরই সামাল দিতে হয়েছে। তারা জানান, ১৯৮৮ সালে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মওদুদ আহমেদ এই ক্ষুদ্র শিল্প এলাকাটি পরিদর্শন করেন। ওই সময় বিসিকের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের এক কোটি টাকার মতো ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। সেই ঋণ পরে যথাযথভাবে পরিশোধ করা হলেও আর কোনো ঋণ সুবিধা পাননি তারা।