Home নির্বাচিত খবর অসাধারণ এক  জননায়ক আবদুর রব সেরনিয়াবাত, জন্মশতবর্ষ আজ

অসাধারণ এক  জননায়ক আবদুর রব সেরনিয়াবাত, জন্মশতবর্ষ আজ

আলম রায়হান:

বিশ্ব কবি বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর কল্পনা করেছিলেন, শত বছর পরও তার কবিতা পড়া হচ্ছে। তার কবিতার চরণ. আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি। বাস্তবে হয়েছেও তাই। শতবর্ষ পরেও রবি ঠাকুরের কবিতা পড়া হচ্ছে। হয়তো পড়া হবে আরো বহু শত বর্ষ। সাহিত্যে যারা সময়কে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের অন্যতম। আর বিশ্বরাজনীতিতে যারা সময়কে অতিক্রম করতে পেরেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদের প্রথম সাড়িতে। বিবিসির জরিপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী। যাকে বহু হাজার বছরেও মানুষ ভুলবে না। এই মহানায়ক বাংলাদেশের স্থপতি।

আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ পালন করেছি ২০২০ সালে, বছরব্যাপী অনুষ্ঠান হয়েছে। মার্চ মাসের রয়েছে আলাদা দোতনা। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস, বাংলাদেশের জন্মদিন। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনও একই মাসে, ১৭ মার্চ। চলতি ২০২১ সালে আমরা আরএক নেতার জন্মশতবর্ষে প্রবেশ করেছি আজ, ২৮ মার্চ। তিনি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, রাজনীতিতে এই গণমানুষের নেতা ছিলেন মানবতার ফেরিওয়ালা। যিনি ছিলেন, ৭৫ এর ১৫ আগস্টে কালরাত্রে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই খুনী চক্রের প্রধান টার্গেট। দুজনের জন্ম লগ্নের মধ্যে পার্থক্য এক বছর।

দুজনের জন্মই মার্চ মাসে, তারিখে পার্থক্য দেড় সপ্তাহের মতো। জন্মের মাস ও রাজনীতির প্রবনতায় তারা একই ফ্রেমে। আর ঘাতকের তপ্ত বুলেট তাদের মৃত্যুকে একই ফ্রেমে আটকে দিয়েছে চরম নৃশংসতায়। সময়ের হিসেবে যে নিষ্ঠুরতার মধ্যে পার্থক্য হয়তো দেড় মিনিটও নয়! এভাবেই জন্ম-মৃত্যুর একই ফ্রেমে আছেন বঙ্গবন্ধু ও আবদুর রব সেরনিয়াবাত। রাজনীতেতে জাতীয় নেতা, বরিশালের প্রিয়তম মানুষ আবদুর রব সেরিনয়াবাতের জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে আজ। আয়োজন করা হয়েছে নানান অনুষ্ঠানের। আজীবন সংগ্রামী ও আত্মত্যাগী রাজনীতিবিদ বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের জন্মশতবর্ষে তাঁকে পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করা হচ্ছে। নেতার জন্মদিনে অপার আনন্দে মেতেছে বরিশালবাসী। নানান আয়োজনে স্মরনীয় হয়ে থাকবে এবার ২৮ মার্চ, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের জন্মশতবর্ষ।

আবদুর রব সেরনিয়াবাত ছিলেন সহজ-সরল, অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত। সাদামাটা ছিলো তাঁর জীবযাপন। একই সময় কর্ম, চিন্তায়, মননে ছিলেন দৃঢ়চেতা; অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। জীবনের কোন পর্যায়েই, এমনকি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালেও, তিনি মোটেই পাল্টাননি। বিলাসী হননি কখনো। কঠিন সময়ও রাজনীতি করেছেন মাটি ও মানুষের কল্যাণে। প্রচলিত ধারায় নিজের ‘কল্যাণ’ নিয়ে তাঁকে কেউ ব্যস্ত হতে দেখেনি কখনো। নীতির প্রশ্নে থেকেছেন অটল; এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে হিমালয়।

ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রাচীনতম জনপদ বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার সেরালে শতবছর আগে জন্ম জননায়ক আবদুর রব সেরনিয়াবাতের। প্রাচীন এই জনপদের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে নিবেদিত প্রান এই রাজনীতিকের জন্ম, তারিখটা ১৯২১ সালের ২৮ মার্চ। পিতা আবদুল খালেক সেরনিয়াবাত, মাতা মোসাম্মৎ নুরুননেছা বেগম। এক বসন্তে তাঁদের ঘর আলো করে এলেন আবদুর রব সেরনিয়াবাত। প্রভাতের সূর্য যেমন সারা দিনের বিষয়ে জানান দেয়, তেমনই কৈশোরেই এই মহান মানুষটির নানান বৈশিষ্টের পরিচয় পাওয়া গেছে। যা নজর কেড়েছে এলাকাবাসী ও স্বজনদের। পরে জেনেছে দেশবাসী, যা বরিশালের মানুষ জানে সবচেয়ে বেশি। জাতীয় নেতা হয়েও বরিশালের প্রতি ছিলো তাঁর আলাদা মমতা। যার প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর পরবর্তী দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজম্মের মধ্যেও।

কৃষককুলের নয়নমনি হিসেবে সমধিক পরিচিত জাতীয় নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত স্কুল জীবন কেটেছে গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এখান থেকে তিনি বৃত্তি নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯৩৯ সালে। তখন ইংরেজ শাসন। দুঃখ-কষ্টে ভরা মানুষের জীবন। শিক্ষার আলো থেকে পিছিয়ে পড়া বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অঞ্চল তখন বরিশাল। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, মুক্তির লক্ষ্যে দৃঢ় পথ চলায় প্রয়োজন শিক্ষা। লেখাপড়ার আগ্রহেই তিনি চলে এলেন বরিশালে। একাদশে  ভর্তি হলেন সে সময়ে অক্সফোর্ড খ্যাত বিএম কলেজে। চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে এ কলেজের তখন সুবর্ণ যুগ। উপমহাদেশব্যাপী এ কলেজের সুনাম মুখেমুখে। শিক্ষকদের অগাধ পা-িত্য, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব স্বভাবতই শিক্ষার্থীদের মনোজগতে গভীর রেখাপাত করতো। মেধাবী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের শিক্ষা জীবনের গোড়াপত্তন ঘটে জ্ঞাণদীপ্ত এই শিক্ষকদের কাছে।

আবদুর রব সেরনিয়াবাত বিএম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন ১৯৪১ সালে। এরপর তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য যান কোলকাতায়। ভর্তি হন সে সময় ভারত বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে। থাকতেন বেকার হোষ্টেলে। এখানেই পরিচয় ঘটে বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে তিনি সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ জনকল্যাণমুখী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। কলেজে পড়াকালে বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগমের সাথে পারিবারিক আয়োজনে বিয়ে হয় আবদুর রব সেরনিয়াবাতের।

সময়টা ভারত ভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টির সন্ধিক্ষণ। এদিকে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের জেরে মানবতা তখন চরম বিপন্ন। কোলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তখন। এর বিরূপ  প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে। সেই ক্রান্তি লগ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন আবদুর রব সেনিয়াবাত। যিনি পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে জীবনের মায়া তুচ্ছ করে দাঙ্গা প্রতিরোধে, মানুষের জানমাল রক্ষা করতে, আহতদের সেবায় নিজেকে উজার করে দিয়েছেন। সেই দৃশ্যপট আবদুর রব সেরিনয়াবাতের চেতনাকে অধিকতর শানিত করেছে। তাঁর চিন্তার জগত করেছে আরো প্রসারিত। তিনি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন, মূলত সেই সময়ে। তখন বেকার হোষ্টেলের প্রভোস্ট ছিলেন প্রখ্যাত দার্শনিক অধ্যাপক সাইদুর রহমান। শিক্ষকদের সাহচর্য, বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী চেতনা জীবন গঠনে আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে  অধিকতর প্রত্যয়ী করে তোলে। তিনি স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন ইসলামিয়া কলেজ থেকে। এরপর কোলকাতার পাঠ চুকিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইনশাস্ত্র নিয়ে পাশ করলেন কৃতিত্বের সাথে। এরপর ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার প্রবনতায় তাঁর গন্তব্য বরিশাল। আইন পেশায় নিয়োজিত হলেন নিজের মাটিতে।

অসাম্প্রদায়িক জননেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত ধর্ম ভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম নীতিগতভাবে মেনে নিতে পারেননি। ১৯৫০ সালে বরিশাল জেলার বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিলে তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ান। তাঁর কারণেই হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত গৌরনদীতে তখন কোনো দাঙ্গা হতে পারেনি। বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনে আবদুর রব সেরনিয়াবাত সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে তিনি ছিলেন অনঢ়। আনুষ্ঠানিক রাজনীতিতে তাঁর সূচনা গণতন্ত্রী দলে যোগ দিয়ে। এই দলটি তখন ভাষা আন্দোলনে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করছিলো। ১৯৫৩ সালে এই দলে যোগ দিয়ে রব সেরনিয়াবাত বরিশাল জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছিলেন এ দলের কেন্দ্রীয় নেতা। ১৯৫৬-৫৭ সালে তিনি গণতন্ত্রী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৫৪ সালে রাজবন্দী হিসেবে কারাবরণ করেন তিনি। ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন হলে তিনি এ দলে যোগদেন। তিনি বরিশাল জেলা ন্যাপের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। বাম রাজনীতির ধারায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।

১৯৫৮ সালে  আইয়ুব খান বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করে দেশে সামরিক আইন জারি করলে ছাত্ররা এর প্রতিবাদে মুখর হয়। আইয়ুব খানের সামরিক আইনের বিরোধিতা করে দেশবরেণ্য নয়জন রাজনৈতিক নেতা একটি বিবৃতি দেন। বরিশালে জননেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত একটি বিবৃতিতে বরিশালের রাজনৈতিক নেতাদের স্বাক্ষর নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এর ফলে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে সামরিক সরকার। তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। আত্মগোপনে থেকেই তিনি সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬৪ সালে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের দাবীতে সর্বদলীয় ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গঠন হলে তাতে যোগ দিয়ে  কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন আবদুর রব সেরনিয়াবাত ।

জননেতা আবদুর রব সেনিয়াবাত ১৯৬৬ সালে বরিশালের স্থানীয় সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ‘করদাতা সমিতি’ গঠন করেন। ১৯৬৯ সালে দেশব্যাপী ১১ দফা  ও ৬ দফা আন্দোলন শুরু হলে তিনি বরিশালে এ আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। এসময় বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি বরিশাল শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং পরবর্তীতে জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ থেকে ৭২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন আবদুর রব সেরনিয়াবাত। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আবদুর রব সেরনিয়াবাত মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। পকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে বাঙ্গালীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ার তিন সপ্তাহেরও আগে ১৭ মার্চ গৌরনদীতে শক্তিশালী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন তিনি। এ প্রস্তুতি তিনি নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের দিকনির্দেশনা থেকেই। মুজিবনগরে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় তাঁর অবদান ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রবাসী সরকারের দক্ষিণাঞ্চলীয় সমন্বয়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁর সেরালের বাড়িটি পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।

একাত্তর পরবর্তী ১৯৭৩ সালে গৌরনদী আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন আবদুর রব সেরনিয়াবাত। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের প্রথম ভূমি মন্ত্রী ছিলেন তিনি। এসময় তিনি ভূমি প্রশাসন, ভূমি সংস্কার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মধ্যে ভূমি ব্যবস্থার সংস্কার, ৭ বছর মেয়াদি খাই-খালাসি আইন প্রবর্তন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, পরিবারের জন্য  সর্বোচ্চ একশত বিঘা জমি সংরক্ষণের সিলিং নির্ধারণ, ভূমিহীনদের মধ্যে সরকারি খাস জমি বিতরণ করাসহ আরো অনেক  পদক্ষেপ ছিলো যুগান্তকারী। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তির উদ্যোক্তা হিসেবে ইতিহাসে খ্যাত। বাংলাদেশ  সরকারের পক্ষে ভারত সরকারের সাথে পানি চুক্তি সম্পাদন করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন বিচক্ষণ নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত।

জননেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত ছিলেন নিবেদিত প্রাণ একজন খাঁটি মানুষ, জনঘনিষ্ঠ রাজনীতিক। পেশায় তিনি ছিলেন আইনজীবি, সম্পৃক্ত ছিলেন সাংবাদিকতায়ও। সাংবাদিকতার মাধ্যমে জনগণের জীবনের সুখ-দুঃখ,আশা- নিরাশা ও ব্যথা-বেদনার কথা, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেয়া যায়, আর সাধারণ মানুষের সমস্যা সমাধানের পথ সুগম হয়- এ ছিলো তাঁর লালিত বিশ্বাস। ‘অসির চেয়ে মসি বড়’- একথা সাংবাদিকতার মাধ্যমে আবদুর রব সেরনিয়াবাত সমুন্নত রেখেছেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান, অবজারভার ও  বার্তা সংস্থা ইউপিআ-এর বরিশাল প্রতিনিধি। তিনি বরিশাল প্রেসক্লাবের প্রথম দিকের সদস্য।

সৎ, নিষ্ঠাবান, নির্লোভ ব্যক্তি হিসেবে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পরিচয় ছিলো সর্বজনবিদিত। কর্মীদের প্রতি তাঁর ছিলো গভীর আস্থা ও বিশ্বাস। জীবনের কোন পর্যায়েই আরাম-আয়েস তাঁকে স্পর্ষ করতে পারেনি। ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। মন্ত্রী হবার পরও মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন, একের পর এক সভা করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে যেভাবে এগিয়ে গেছেন, তেমনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন মন্ত্রী হবার পরও। ১৯৭৩ সনে আগৈলঝাড়ার বাসাইলে মিটিং করতে গেছেন কসবা থেকে সাড়ে ৫ মাইল পায়ে হেঁটে। আবার ফিরেছেনও পায়ে হেঁটে। যা সেই সময়ই ছিলো বিশেষ আলোচিত ঘটনা।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠিত হলে আবদুর রব সেরনিয়াবাত বাকশালে যোগ দেন। এবং সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদ লাভ করেন। এই মহৎ মানুষটিকে কেড়ে নিয়ে নিষ্ঠুর ঘাতকের বুলেট, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে। যে রাতে ঘাতকের নির্দয় বুলেট নিভিয়ে দেয় বাংলাদের প্রাণপ্রদীপ বঙ্গবন্ধুকে। ঢাকা দক্ষিনের বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের মাতা, রব সেরনিয়াবাতের মেয়ে আরজু মনি, বেবী সেরনিয়াবাত এবং কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াবহ কালো রাতে পিতা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মতো শহিদ হন। সেদিন পাষন্ডদের  হাত থেকে রেহাই পায়নি আবদুর রব সেনিয়াবাতের নাতি, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং সাহান আরা বেগমের শিশু পুত্র সুকান্ত বাবু।

ঘটনাচক্র ১৫ আগস্টের সেই ভয়াল রাতে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বেঁচে যান। সেদিন ঘাতকের বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে, মৃত্যু অনিবার্য জেনেও অবিচল থেকেছেন আবদুর রব সেরনিয়াবাত। ফলে ঘাতকরা আবুল হাসানাত আবদুল্লার খোঁজ পায়নি। যদিও তিনি বাড়িতেই ছিলেন। এদিকে তাঁর স্ত্রী সাহান আরা বেগম গুলিবিদ্ধ হয়েও প্রাণে বেঁচেছেন অনেকটা অলৌকিক ভাবে। এবং অক্ষতভাবে বেঁচে যান সেদিন শিশু সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ, যিনি এখন বরিশালের সফল ও কার্যকর মেয়র। রাজনীতিতে সেরনিয়াবাত পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছেন সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ।

আবদুর রব সেরনিয়াবাতের চরিত্রের স্বচ্ছতার কোনো পরিবর্তন কেউ দেখেননি কখনোই। মন্ত্রীর কাজের জন্য ব্যবহৃত নির্ধারিত গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ি ব্যবহার করাতো দূরের কথা, বাসায়ও রাখতেন না। সরকার  সেসময় মন্ত্রীদের ১০ কাঠা করে জমি বরাদ্ধ দিয়েছিলেন। কিন্তু আবদুর রব সেরনিয়াবাত সেই জমি গ্রহণ করেননি। তাঁর সহধর্মিণী বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বোন ভাইকে বলেছিলেন, ‘মিয়া ভাই, হাসনাতের আব্বাতো জমি নিতে চায় না।’ জাতির পিতার উত্তর ছিলো, সে না নিলে তোমারও নেয়া উচিত না।

গণমানুষের নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত দলের প্রতি ছিলেন খুবই আন্তরিক। আইনজীবি হিসেবেও ছিলেন সফল। চলনে-বলনে ছিলেন অত্যন্ত সাধারণ। পাজামা-পাঞ্জাবীর সাথে শেরওয়ানীই পরতেন। তাঁকে কেউ কখনও কোর্ট প্যান্টে কেতাদুরস্থ দেখেনি। তিনি মনে প্রাণেই ছিলেন বাঙালী। সারাজীবন খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবি পড়েছেন। খাবারেরও ছিলেন অতি সাধারন প্রবনতার। তাঁর প্রিয় ছিলো শাক সবজী আর ডাল। সকলকে তিনি ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে, সকলের জন্যই ছিলো তার মমতা। এদিকে পরিস্থিতি অনুধাবনে তাঁর ছিলো অসাধারণ ক্ষমতা। একাত্তরে দেশী-বিদেশী পরাজিত শক্তি ৭৪-৭৫’র যে ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলো তা থেকে তিনি হয়তো ভয়ংকর অঘটনের আশংকা করছিলেন। প্রায়ই বন্ধু-সহকর্মীদের বলতেন, ‘একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন।’ কিন্তু তিনি নিজে হয়তো সাবধান হবার তাগিদ বোধ করেননি কখনো। যেমন করেনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও। আসলে যারা মানুষ নিয়ে ভাবেন, অন্যকে নিরাপদে রাখতে কাজ করেন তারা সম্ভবত নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবেন না। এমন স্বাক্ষর বহন করে, বিশ্ব ইতিহাস।

সংগ্রামী ও ত্যাগী জননেতা শহিদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত আজ আমাদের মাঝে নেই। মাঝখানে চলে গেছে পয়তাল্লিশটি বছর। রাজনীতিতে মানবতার ফেরিওয়ালা, সমাজ প্রগতির অগ্রদূত এই অসাম্প্রদায়িক মানুষটির জন্মশতবর্ষ আজ, ২৮ মার্চ। এদিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক, তাঁর আদর্শ সমুন্নত রাখা; তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করা। এবং জনগণের কল্যাণ হোক রাজনীতিকদের মূলমন্ত্র। শুভ জন্মদিন বরিশালের কৃতি সন্তান হে গণমানুষের নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, আপনাকে সালাম।

তথ্যসূত্র: ইমানুল হাকিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেশনাল এমবিএ প্রোগ্রাম চালু

কাজী হাফিজ: বর্তমান বিশ্বে মাস্টার্স অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন (এমবিএ) প্রোগ্রামকে ব্যবসা এবং ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন কোর্স হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের চাহিদার কথা...

গাড়িতে আসার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলেন রনোভাই

প্রায় দুই দশক আগে এসটিভি ইউএস নামে একটি টেলিভিশন আমেরিকা থেকে সম্প্রচারিত হতো। কিন্তু কার্যক্রম পরিচালিত হতো বাংলাদেশ থেকে। এতে মুখোমুখি নামে একটি টকশো...

মাছ ধরার সময় শ্বাসনালিতে বাইন মাছ

দখিনের সময় ডেস্ক: ঝুঁকিপূর্ণ দেখে তিন ঘণ্টার চেষ্টায় শ্বাসনালি কেটে বাইন মাছটি বের করা হয়। এরপর রোগী সুস্থ হলে ৭-৮ দিন পর তার শ্বাসনালিতে বসানো...

অধ্যক্ষের রুমে ঢুকে শিক্ষক পেটানো সেই ছাত্রলীগ নেতা বহিষ্কার

দখিনের সময় ডেস্ক: কলেজে অধ্যক্ষের রুমে ঢুকে শিক্ষক পেটানো ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। শিক্ষককে পেটানো বহিষ্কৃত এ ছাত্রলীগ নেতা হলেন মো. সাফাতুন নুর...

Recent Comments