আলম রায়হান:
প্রায় অর্ধশত বছর আগে শোনা। পুরনো কথা। এর কেন্দ্রে ছিলেন এক নেতা। পুরোটা বিষয় মনে নেই, এমনকি স্মরণে নেই কে ছিলেন সেই নেতাটি। বিষয়টি নিশ্চিত হবার জন্য তপংকর চক্রচর্তীর সঙ্গে কথা বলি টেলিফোনে। কিন্তু তিনিও নেতার নামটি নিশ্চিত করতে পারেননি। প্রসঙ্গত, তপংকর চক্রচর্তী নানান পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত। তিনি শিক্ষাবিদ-সাংবাদিক-লেখক-ছড়াকার হিসেবে সমধিক পরিচিত। আমিও তাকে এসব পরিচয়ে চিনি। এবং আর একটু বেশি চিনি। যার সূচনা হয় বরিশালের গত মেয়র নির্বাচনের প্রাক্কালে। সে প্রসঙ্গ হয়তো বলবো অন্য কোন এক দিন।
আজকের প্রসঙ্গে আসি। ঘটনা অথবা গল্পটি এ রকম, ব্রিটিশ ভারতে এক নেতা অনুষ্ঠানে গেলেন ট্রেনে। তাকে রিসিভ করার জন্য স্টেশনে সঙ্গত কারণেই লোকজন জড়ো হয়েছে। কিন্তু নেতাকে ট্রেন থেকে নামতে না দেখে যখন বেশ অনিশ্চতা দেখাদিলো তখন, একজনের চোখে পড়লো, প্রত্যাশিত নেতা দাড়িয়ে আছেন তৃতীয় শ্রেনীর কম্পাটমেন্টের সামনে। সবাই দৌড়ে তাঁর কাছে গেলেন। বললেন, আপনি এখানে কেন? নেতা নির্লিপ্তভাবে বললেন, তৃতীয় শ্রেনীর পর তো কোন কম্পার্টমেন্ট নেই!
বলাভালো, এই প্রবনতার নেতা এখন আর পাওয়া চেষ্টা করা খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতো। অথবা সোনার পাথরবাটি। শুধু নেতা বলে কথা নয়, সকল শ্রেনীর মানুষের প্রবনতাই সর্বোচ্চ সুযোগটি গ্রহণ করা। তা ভেধ-অভেধ যাই হোক। সবাই জেনো উপড়ের দিকে ছুটছে এবং এই উপরের কোন সীমা নেই। এ ব্যধিতে জেনো সবাই আক্রান্ত। মানসিক এই সংক্রমের মধ্যে ১৭ মার্চ আমার অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো, বরিশাল থেকে ঢাকা আসার পথে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে ধরা দেয়ার পর দক্ষিণ অঞ্চলের ২৪ জেলায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে অনেকেরই পছন্দের মাধ্যম হয়ে গেছে সড়ক পথ। এবং ভরসা বাস। আগে ছিলো লঞ্চ।
বরিশাল-ঢাকা রুটে লঞ্চের মতো বাসেও নানান রকমের জুলুম চলে। এ জুলুম প্রতিকারের আশা দুরাশা। হেটে চাঁদে যাবার মতো। কারণ অনিয়ম দেখার জন্য যারা সরকারের কাছ থেকে টাকা পান তাদের অনেকেই পরিবহন থেকেও টাকা হাতান। ফলে সরকারী দায়িত্ব পালনের চেয়ে এরা বেশি অনুগত পরিবহন মাফিয়া চক্রের প্রতি। এরপরও বরিশাল যেতে সড়কপথ যাত্রী প্রবনতা বেশ গতি পেয়েছে। এ ধারায় আমিও আছি। বরিশাল থেকে দৈনিক দখিনের সময় প্রকাশ করা এবং জীবিকার জন্য ঢাকার কাজ করার কারণে আমাকে অনেকটা মাকুড়ের মতো ঢাকা-বরিশাল করতে হয়। এ ক্ষেত্রে আমি বাসের যাত্রী। প্রথম বার উঠেছি বিআরটিসি বাসে। কিন্তু বাসের আসন বিন্যাস এমন যে বসা খুবই কষ্টকর। ফলে বাধ্য হয়েই প্রতিবার দুইশ’ টাকা খরচ বাড়িয়ে বেছে নিয়েছি গ্রীন লাইন পরিবহন বাস। বলে রাখা প্রয়োজন, এ বাসে বসতে তেমন অনুবিধা না হলেও ইকোনমী ক্লাশ হিসেবে যে বাসগুলো চালানো হয় সেগুলো নাকি অন্য রুটের বাতিল বাস। এ শোনা কথা। এই পরিবহনের বিজনেস ক্লাশ হিসেবে যে বাসগুলো চলে তা মোটামুটি ভালো বলেই মনে হয়। কিন্তু এ বাসে যেতে হলে গুণতে হবে অতিরিক্ত সাড়ে তিনশ’ টাকা। এরপরও ভাবি, ‘কী আছে জীবনে, যাই না বিজনেস ক্লাশে!’ প্রতিবারই ভাবি। কিন্তু এই ভাবনাটা বাস্তবে ধরা দেয়নি এখনো। ১৭ মার্চও ঢাকা মুখি বাসে উঠে ভেবেছি, এই লক্করঝক্কর বাসে আর উঠবো না। পরের বার উঠবো বিসনেস ক্লাশেই!
এই ভাবনার ডালপালার মধ্যে থাকা অবস্থায় ডান দিতে চোখ পড়লো। একজনকে মনে হলো পরিচিত। পরে ভাবলাম, আরে না; সে এই বাসে উঠবে কেন! আবার তাকালাম। আবারও পরিচিত মনে হলো। কিন্তু সংশয় কাটে না। অগত্যা বাসের সুপারভাইজারকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি? সুপারভাইজার ইতিবাচক উত্তর দিলেন। আমাকে অন্য ভাবনায় পেয়ে বসলো। এমনো ভাবলাম, ভিসি কি পালিয়ে বরিশাল ছাড়ছেন? ততক্ষনে বাস ঢাকার পথে চলতে শুরু করেছে।
ঘন্টা দেড়েক পর যাত্রা বিরতি হলো। ২০ মিনিটের বিরতি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিরতির প্রধান কাজ সেরে সবাই যখন বাস ছাড়ার অপেক্ষায় তখন মুখোমুখি হলাম বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. ছাদেকুল আরেফিনের। কুশল বিনিময়ের পর্বে নিজের পরিচয় দিলাম। আমাকে স্মরণ করতে তাঁর মোটেই অসুবিধা হয়নি। এতে আমি কিঞ্চিত অবাক হলাম। কারণ মন্ত্রিপরিষদের মোঃ মাহবুব হোসেন শিক্ষা সচিব থাকাকালে ভিসি ছাদেকুল আরেফিনের সঙ্গে পরিচয় এবং দেখা হয়েছে মাত্র দুই বার, তার অফিসে। তাও প্রায় বছর দুই আগের ঘটনা।
বরিশাল মেট্রোপলিটান পুলিশের বন্দর থানার সাবেক এক ওসির অনুরোধে ভিসি অধ্যাপক ড. আরেফিন চা খেতে রাজী হলেন। উপচার্য হয়ে পূর্বের দেখা-সাক্ষাতের বিষয়টি স্মরণ করতে পারলেও পুলিশ কর্মকর্তাটি আমাকে খুব পাত্তা দিলেন বলে মনে হলো না। এ হয়তো পুলিশে সক্রমিত অহমের প্রকাশ। সে অন্য প্রসঙ্গ। ভিসির সঙ্গে সময়টা ধরে রাখার জন্য সাধারণ প্রস্তাব দিলাম। ভিসি অতি সাধারণ মানুষের মতো সম্মতি দিলেন। আমরা ছবির ফ্রেমে আবদ্ধ হলাম বাস সুপারভাইজারের সহায়তায়।
আমি নিশ্চিত হলাম, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পালিয়ে যাচ্ছেন না। তবে এখানেই ভাবনার সমাপ্তি ঘটেনি। ভাবলাম, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসি লক্করঝক্কর বাসে যাচ্ছেন কেন? তারতো ফুল টাইম দুইখান আলিশান গাড়ি আছে। এছাড়া একই পরিবহনের তো বিজনেস ক্লাশ বলে একটু উন্নত বাস আছে। কিন্তু নিজের গাড়ি নয়, অতিরিক্ত সাড়ে তিনশ টাকার বাসেও নয়, সঙ্গে কোন পাইক-পেয়াদাও নেই। এ প্রসঙ্গে অনেকক্ষণ ভাবলাম। অনেক ভাবলাম। বাসে উঠলে তো আর কোন কাজ থাকে না! কিন্তু কারণ বুঝলাম না। অবশ্য বোঝার কথাও নয়। তাই বলে হাল ছাড়িনি।
নির্ধারিত সময়ের অন্তত দেড় ঘন্টা পর বাস গন্তব্যে পৌছলো। আমরা একত্রে নামলাম। বিদায় পর্বে অনেকটা খাপছাড়া ভাবে প্রশ্ন করলাম, ‘ফুল টাইম ব্যবহারের জন্য দুইখান গাড়ি থাকা সত্ত্বেও আপনি বাসে কেন? আর কেনই বা ইকোমি ক্লাশে? উত্তরে সাংবাদিকদের সহজাত প্রবনতা মৃদু স্মরণ করিয়ে দিয়ে সহাস্যে ভিসি ড. ছাদেকুল আরেফিন বললেন, ‘বি সিম্পল।’ ব্যাস আমাকে অন্য চিন্তায় পেয়ে বসলো। সিম্পল হওয়া কি অত সহজ? অথচ সিম্পল হলে অনেক কিছুই সহজ হয়!