Home শীর্ষ খবর ৪৭ হাজার ফুট উপরে ৪০ মিনিটের লড়াই, বেঁচে ফেরেন বিমানচালক

৪৭ হাজার ফুট উপরে ৪০ মিনিটের লড়াই, বেঁচে ফেরেন বিমানচালক

দখিনের সময় ডেস্ক:

ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৭ হাজার ফুট উপরে বজ্র-মেঘের সঙ্গে ৪০ মিনিট লড়াই করেছেন। মৃত্যু যেখানে অনিবার্য ছিল—তবে বেঁচে ফেরার ক্ষীণ আশা কাজে লাগিয়ে নতুন জীবন পেয়েছেন। তিনি মার্কিন এক সেনাকর্তা র‌্যানকিন। ‘দ্য ম্যান হু রোড দ্য থান্ডার’ নামে বইতে র‌্যানকিন  নিজের সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। ষাটের দশকের গোড়ায় বইটি প্রকাশিত হয়।  র‌্যানকিন-সহ বিশ্বে দুজন মানুষ এমন অসম্ভবকে সম্ভব করে অনিবার্য মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছেন। অপরজন জার্মানির প্যারাগ্লাইডার ইওয়া উইসনিরস্কা। তিনিও বজ্রগর্ভ মেঘের কাছে হার মানেননি।

র‌্যানকিন ছিলেন মার্কিন মেরিন কর্পস-এর যুদ্ধবিমানচালক। তার ঝুলিতে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও কোরীয় যুদ্ধে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা। ১৯৫৯ সালের ২৬ জুলাই র‌্যানকিনের জীবনে সেই  ভয়াল সন্ধ্যা নেমে আসে। সে দিন এফ-৮ ক্রুসেডার নামে একটি যুদ্ধবিমান নিয়ে ম্যাসাচুসেট্‌সের দক্ষিণ ওয়েমাউথের বিউফোর্ট এলাকার নৌসেনা ঘাঁটি থেকে রওনা দেন তিনি। ‘দ্য ম্যান হু রোড দ্য থান্ডার’ বইয়ে র‌্যানকিন জানান, উড়ানের সময় আবহাওয়া মনোরম থাকলেও ধীরে ধীরে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হতে শুরু করে। শীঘ্রই যে ঝড় আসছে, তা বেশ বুঝতে পারছিলেন তিনি। সেখান থেকে মাটি ছুঁতে প্রায় আধ ঘণ্টার পথ। ঘরিতে সন্ধ্যা ৬টা এমন সময় আচমকা সজোরে বিমানের পেছনে একটা ধাক্কা লাগে। সঙ্গে সঙ্গে বিমানের ইঞ্জিনে বিকট আওয়াজ হয়। এর পর একের পর এক ধাক্কায় কেঁপে উঠেছিল বিমানটি। বজ্রগর্ভ মেঘের কবল এড়াতে ৪৫ হাজার ফুট উঁচুতে ওড়া বিমানটিকে আরও উঁচুতে নিয়ে যান র‌্যানকিন। ততক্ষণে চালকের আসনে থাকা র‌্যানকিনের সামনের ইন্‌সুমেন্টস প্যানেলে তখন নানা সতর্কীকরণ আলো জ্বলতে শুরু করেছে। তারই মধ্যে একটিতে লেখা ফুটে উঠল, ‘ফায়ার’। র‌্যানকিনের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে বিমানের ইঞ্জিন অত্যন্ত গরম হয়ে উঠেছে। যে কোনও সময় তাতে আগুন ধরে যেতে পারে।

বিপদ বুঝে ইঞ্জিনের উপর চাপ কমাতে সেখানকার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেন র‌্যানকিন। এর পর রেডিয়োতে নোলানকে জানিয়ে দেন, জীবন বাঁচাতে হয়তো নিজেকে বিমানের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। রেডিওতে যুদ্ধবিমানটির অবস্থা জানানোর সময় সেটি ৪৭ হাজার ফুট উঁচুতে উড়ছিল। সেখান থেকে বাইরে ঝাঁপ দেওয়ার অর্থও মৃত্যুর মুখে নিজেকে ঠেলে দেওয়া। তবে র‌্যানকিনের কাছে আর কোনও উপায়ও ছিল না। বাইরে তখন বরফঠান্ডা। নিজের বইয়ে র‌্যানকিন লিখেছেন, ততক্ষণে ইজেকশন সিটে আগুন লেগে গেছে, তা বুঝতে পেরেছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন, একটি বিশালাকার হাতি আমায় লাথি মেরেছে। একই সঙ্গে বিকট শব্দে নাক ডাকছে। ইঞ্জিনের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও বিমানটি আরও উঁচুতে ভাসতে শুরু করেছিল। ফলে ইজেকশন সিটের মাধ্যমে বিমানের বাইরে বার হওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না র‌্যানকিনের। বিমানটির গতি হারানোর অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।

পরে বিমানের বাইরে বের হওয়া মাত্রই ঠান্ডা যেন তীরের মতো বিঁধতে শুরু করেছিল র‌্যানকিনকে। সে সময় তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের থেকে ৭০ ডিগ্রি নীচে। বরফজমাট ঠান্ডার ছোঁয়া লাগতেই শরীরের সমস্ত অংশ ফুলতে শুরু করে। কাঁধ, মুখ, কব্জি থেকে গোটা হাত বেয়ে গোড়ালি— ঠান্ডার কামড়ে ফুলছিল সবই। বায়ুর অত্যধিক চাপে নাক-কান-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করেছিল।

র‌্যানকিন লিখেছেন, ‘মনে হচ্ছিল যেন কোটর থেকে চোখ দুটো কেউ উপড়ে নিয়ে যাবে। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল, দু’কান ফেটে আসছিল। গোটা শরীর জুড়ে খিঁচুনি শুরু হয়েছিল। বিমানের বাইরে বেরিয়ে বজ্র-মেঘের মধ্যে পড়েছিলেন তিনি। ঘুরপাক খেতে খেতে নীচে পড়তে শুরুও করেন। এরমধ্যেই কোনোভাবে অক্সিজেনের নলটি নিজের মুখে গুঁজে দেন। এভাবে যেন মৃত্যুর কাছ থেকে কিছুটা সময় কিনে নেন র‌্যানকিন। শূন্যে থাকার সময় প্রায় ১০ হাজার ফুট উপরে থাকার সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্যারাশুট খুলে যায়। ঘন মেঘের মধ্য দিয়ে নীচে নামার সময় ঘড়ির দিকে এক বার চোখ পড়েছিল র‌্যানকিনের। প্রায় পাঁচ মিনিট কেটে গেছে। এক সময় অক্সিজেনও ফুরিয়ে যায়। তবে সে সময় বায়ুর ঘনত্ব যে মাত্রায় ছিল, এতে সাধারণভাবে শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছিল না। এভাবেই প্রায় ১০ মিনিট কেটে যায়। আচমকা দমকা হাওয়ায় তাকে ঘন মেঘের ভেতরে ঠেলে দিয়েছিল। হাওয়ার বেগে ওঠানামা করছিলেন র‌্যানকিন।

অবশেষে বৃষ্টির দাপট কমতে থাকে। এক সময় র‌্যানকিন দেখেন, মাটি থেকে প্রায় ২০০-৩০০ ফুট উপরে রয়েছেন তিনি। প্যারাশুটে জড়িয়ে কোনও মতে মাটিতে নামলেও তখন গোড়ায় র‌্যানকিনের উদ্ধারে এগিয়ে আসেননি কেউ। রক্তাক্ত, হাড়ভাঙা, বমিতে মাখামাখি হয়ে মাটিতে নেমে র‌্যানকিন দেখেন, ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিট। অর্থাৎ ৪০ মিনিট ধরে দানবিক মেঘের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত র‌্যানকিনকে উদ্ধার করে একটি দোকানে নিয়ে যান এক গাড়িমালিক। সেখান থেকেই ফোন করে ডাকা হয় অ্যাম্বুল্যান্স। নর্থ ক্যারোলাইনার একটি হাসপাতালে দীর্ঘ দিন তার চিকিৎসা চলেছিল। বরফের ক্ষতের মতো হাতে, মুখে, গোটা শরীরে ক্ষত হয়ে গিয়েছিল তার। বেশ কয়েক সপ্তাহ পর সুস্থ হয়ে ফের কাজে যোগ দেন র‌্যানকিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

কোথাও সরকারিভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়নি, দেশকে অশান্ত করার ষড়যন্ত্র চলছে

দখিনের সময় ডেস্ক: সরকারিভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়নি জানিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, দেশের পাহাড়ি এলাকাতেও বহুমুখী ষড়যন্ত্র থেমে...

দ্রুত প্রণয়ন করা হবে বিচারক নিয়োগ নীতিমালা: প্রধান বিচারপতি

দখিনের সময় ডেস্ক: প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন করা হবে। একই সঙ্গে সুনির্দিষ্ট আইনও করা হবে বলে...

গায়েবি মামলার কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে: আসিফ নজরুল

দখিনের সময় ডেস্ক: অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, বিচার বিভাগ ব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিগত...

ইসরায়েলে মশাবাহিত ‘ওয়েস্ট নাইল’ ভাইরাসে নিহত ৭০, আক্রান্ত ৯১৩

দখিনের সময় ডেস্ক: মধ্যপ্রাচ্যের দু’টি দেশ লেবানন ও ফিলিস্তিনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইসরায়েল। গাজায় যুদ্ধ শেষ করতে না করতেই, দেশটি নতুনভাবে লেবাননে যুদ্ধ শুরু করেছে। এদিকে, মশাবাহিত...

Recent Comments