দখিনের সময় ডেক্স:
আটলান্টিক মহাসাগরে টাইটানিক জাহাজটি ডুবে যায়, ১৯১২ সালের ১৫ই এপ্রিল রাতে। তখন কয়েক হাজার যাত্রীর জায়গা হয় সাগরের বরফ ঠাণ্ডা পানি। ডুবন্ত জাহাজটির লাইফবোটগুলোর মধ্যে একটি পরে ফিরে এসে খোঁজার চেষ্টা করেছিল পানিতে কেউ তখনও বেঁচে আছে কিনা।
টাইটানিক জাহাজ থেকে থেকে যারা বেঁচে ফিরেছিলেন তাদের মধ্যে ছয় চীনা নাগরিক ছিলেন। অলৌকিকভাবে সেই রাতে প্রাণে বেঁচে গেলেওে দুর্ভাগ্য, দু:সময় পিছু ছাড়েনি ঐ ছয়জন চীনার। টাইটানিকে ডোবার পরপরেই ঐ ছয়জন চীনা যে বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলেন, একশ বছরের বেশি সময় পরও করোনাভাইরাসের প্যানডেমিকের কারণে আমেরিকাতে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হচ্ছেন চীনা বংশোদ্ভূতরা। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা বংশোদ্ভূতদের লক্ষ্য করে বর্ণবাদী হামলার হাজার হাজার ঘটনা ঘটেছে। তাদের গায়ে হাত দেওয়া হয়েছে, গায়ে থুতু ছেটানো হয়েছে, গালি-গালাজ করা হচ্ছে।
টাইটানিক থেকে রক্ষা পাওয়া যাত্রীদের নিউ ইয়র্কের এলিস আইল্যান্ডের অভিবাসন অফিসে নিয়ে আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমেরিকা থেকে ঐ ছয়জন চীনাকে বহিষ্কার করা হয়। কারণ সে সময় আমেরিকায় একটি আইন ছিল যে, কোনো চীনা নাগরিককে সেদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
তবে ঐ ট্রাজেডির ১০৯ বছর পর সম্প্রতি প্রাণে বাঁচা ঐ ছয়জন চীনাকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি হয়েছে যেটি চীনে প্রদর্শিতও হয়েছে। ঐ তথ্যচিত্রে টাইটানিক ডোবার এবং ঐ ছয়জনের রক্ষা পাওয়ার পর্বই শুধু নয়, পরে তাদের ভাগ্যে কী হয়েছিল তাও জায়গা পেয়েছে। তখনকার আমেরিকায় অভিবাসী বিদ্বেষ, বর্ণ বিদ্বেষের চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। টাইটানিক থেকে যারা বেঁচেছিলেন, তাদের নিয়ে মিডিয়ায় তখন বিস্তর মাতামাতি হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসবিদ এবং গবেষকদের মতে, শুধু ঐ ছয়জন চীনার কপালেই জুটেছিল দুর্নাম, নিন্দা আর কটূক্তি। আর এর পেছনে ছিল তখনকার পশ্চিমা সমাজে চীন এবং চীনা বিদ্বেষ।
টাইটানিক ডোবার কয়েক দিন পর ব্রুকলিন ডেইলি ঈগল নামে একটি পত্রিকায় এক রিপোর্টে ঐ ছয় চীনাকে ”জীব” হিসাবে বর্ণনা করে বলা হয় ”বিপদের গন্ধ পাওয়ার সাথে সাথেই” তারা লাফ দিয়ে লাইফ বোটে চড়ে বসেছিল এবং পরিচয় গোপন রাখার জন্য সিটের নিচে মুখ ঢেকে রেখেছিল। কিন্তু নতুন এই তথ্যচিত্রটি তৈরির জন্য করা গবেষণায় দেখা গেছে এ ধরনের কথা ছিল পুরোপুরি মনগড়া। টাইটানিকের লাইফবোটের হুবহু আদলে তৈরি নৌকা তৈরি করে দ্য সিক্সের প্রযোজনা দলটি দেখেছেন ঐ রকম নৌকার সিটের নিচে লুকিয়ে থাকা অসম্ভব ছিল।
তথ্যচিত্রটির পরিচালক মি. জোনস্ বলেন, আজও আমরা একই প্রবণতা দেখছি। মিডিয়া বিনা কারণে অভিবাসীদের অপরাধী হিসাবে টার্গেট করছে। সেসময় পশ্চিমা অনেক মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হয় যে লাইফবোটে জায়গা পেতে ঐ চীনারা মেয়েদের পোশাক পরে ছিল। টাইটানিক নিয়ে গবেষণা করেছেন ঐতিহাসিক টিম মালটিন। তিনি বলেন, প্রাণে বাঁচা ঐ ছয় চীনা লাইফ বোটে লুকিয়ে ছিলেন বা নৌকায় জায়গা পেতে নারীর ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন এমন কোনই প্রমাণ নেই। তিনি বিবিসিকে বলেন, ”মিডিয়া এবং অনেক মানুষ সেসময় এসব কথা স্রেফ বানিয়েছিল।”
চীনা ঐ যাত্রীরা বরঞ্চ অন্যদের সাহায্য করার চেষ্টা করছিলেন। যেমন, ফ্যাং ল্যাং নামে যে চীনা যুবক জাহাজের দরজা ধরে ভাসছিলেন, উদ্ধার হওয়ার পর তিনি ঐ লাইফ বোটটি চালিয়েছিলেন এবং নৌকার সবাইকে নিরাপদে রাখতে সাহায্য করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করে ঐ ছয় চীনা নাগরিককে কিউবাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।